নারী প্রেম ও নারী আসক্তি ইহজাগতিক ও পরজাগতিক বহু বিপর্যয়ের কারণ :
ইবনে জাওজী রহ. এসব বিপর্যয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন,
‘নারী প্রেম ও নারী আসক্তির প্রায়শ্চিত্য বিভিন্ন প্রকার। কখনো ভোগ করতে হয় সঙ্গে সঙ্গে কখনো দেরিতে, কখনো প্রকাশ পায় কখনো তা পায় না। আবার এর কিছু শাস্তি রয়েছে যা আক্রান্ত ব্যক্তি নিজেও বুঝতে সক্ষম হয় না। তবে সব চেয়ে বড় শাস্তি হচ্ছে
> আল্লাহকে ভুলে যাওয়া ও ইমান বিলুপ্ত হওয়া।
> নারী আসক্তি ও গুনাহের কারণে অন্তর মরে যায়,
> যার ফলে সে আল্লাহর সঙ্গে মুনাজাতের স্বাদ আস্বাদন করতে সক্ষম হয় না,
> পবিত্র কুরআন তার অন্তরে অবস্থান করে না।
> এস্তেগফারসহ অন্যান্য এবাদত তার কাছে অর্থহীন মনে হয়।
> আরো অনেক ধর্মীয় অবক্ষয় রয়েছে, যা তাকে আস্তে আস্তে গ্রাস করে নেয়, যা সে অনুধাবনও করতে পারে না।
> তার অন্তরের দিগন্ত জুড়ে বিস্তৃত হয় গুনাহের অন্ধকার,
> নষ্ট হয়ে যায় তার অন্তর দৃষ্টি, যার প্রভাব পড়ে তার শরীরেও। যেমন, চোখের দৃষ্টি চলে যায়, স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে ইত্যাদি।
তাই অন্তরের মধ্যে গুনাহের আসক্তি উপলব্দি করার সাথে সাথে তওবা করা, হয়তো এর দ্বারা আসন্ন বিপদ দূরীভূত হয়ে যাবে।’ [জাম্মুল হাওয়া : ২১৭]
অবৈধ ভালবাসা সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়াহ রহ. বলেন,
‘নারী কিংবা ছোট বাচ্চাদের আসক্তি ব্যক্তিকে এমন বিপর্যয়ে নিপতিত করতে পারে, যার থেকে উদ্ধার করার ক্ষমতা কারো নেই। এর পরিণতি খুবই ভয়াবহ, তার পূন্যের ভাণ্ডার একেবারে শূন্য হয়ে যায়। প্রথম পর্যায়ে কারো অন্তরে কোন চেহারার আসক্তি সৃষ্টি হলে, দ্বিতীয় পর্যায়ে সে তার ভালবাসায় মগ্ন হয়ে যায়। যার ফলশ্রুতিতে সে আস্তে আস্তে নানা অপকর্ম ও অপরাধে জড়িত হয়ে পড়ে, যা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। তবে সব চেয়ে বড় মসিবত হচ্ছে আল্লাহর রহমত থেকে দূরে নিক্ষিপ্ত হওয়া। কারণ, বান্দা যখন আল্লাহর এবাদত ও তার প্রতি নিবিষ্ট চিত্ত থাকে, তখন তার কাছে আল্লাহর মহব্বতের চেয়ে মধুর ও সুখকর কোন জিনিস হতে পারে না।’ [মাজমুউল ফতওয়া : খ ১০, পৃ : ১৮৭]
তিনি আরো বলেছেন, গুনাহের প্রতি আসক্তি অন্তরের অন্যতম ব্যাধি, যা উন্মাদনার জন্ম দেয়। লুত আ.-এর জাতি সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন,
‘তোমার জীবনের কসম, নিশ্চয় তারা তাদের নেশায় ঘুরপাক খাচ্ছিল।’ [হিজর : ৭২]
বুখারি ও মুসলিমে বর্ণিত একটি হাদিসে এসেছে, আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘চোক্ষুদ্বয়ও যেনা করে, চক্ষুর যেনা হচ্ছে দৃষ্টি।’
অনেকেই প্রবৃত্তির তাড়নায় পরনারীর প্রতি দৃষ্টি দেয়, তাদের কথা শ্রবণ করে ও তাদের সঙ্গে বাক্যালাপ করতে চায়। আবার কেউ এর চেয়ে অগ্রগামী হয়ে র্স্পশ, চুম্বন ও সংগ লাভ করতে চায়। এসব কিছুই নিষিদ্ধ ও হারাম। এসব লোকদের ওপর শাস্তি নিশ্চিত করার ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা আমাদের নমনীয় হতে ও দয়া দেখাতে নিষেধ করেছেন। (মুসলমানদের সরকার না থাকলে বা তাদের শাস্তির কোন ব্যবস্থা না থাকলে) সামাজিকভাবে তাদের বয়কট করা, তাদেরকে এ থেকে নিষেধ করা ও তাদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করা। অতএব যেনার এসব প্রাথমিক কার্যাদি ও যেনার অন্যান্য সকল উপায়-উপকরণ ত্যাগ করা, তার থেকে দূরে থাকা সবার জন্য একান্ত জরুরি।’
[মাজমুউল ফতওয়া : খ : ১৫ পৃ : ২৮৮, ২৮৯]
ইবনুল কাইয়ূম রহ. যেনা-ব্যভিচারের ক্ষতি, বিপর্যয় ও সর্বনাশ সম্পর্কে তার লেখার অনেক জায়গায় আলোকপাত করেছেন। তিনি একজায়গায় বলেন,
‘যেনা-ব্যভিচার সকল অপকর্ম ও অনিষ্টের মূল। ব্যক্তির দীনদারী, কৌলিণ্য, সুস্থ রুচিবোধ ও আত্মমর্যাদা সব নিঃশেষ করে দেয় এ অপকর্মটি। ব্যভিচারীর মধ্যে দীনদারী, ওয়াদা রক্ষা ও সততা থাকে-না বললেই চলে।
আরো কিছু ক্ষতিকর দিক হচ্ছে :
> আল্লাহর নিদের্শ অমান্য করা ও তার সৃষ্ট প্রকৃতির মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা।
> নিজ চেহারা কলুষিত করা এবং নিজকে চিন্তা ও পেরেশানীর ঘাটে উপস্থিত করা।
> এর ফলে ব্যক্তির অন্তর কালো হয়,
> অন্তরদৃষ্টি লোপ পায়,
> সম্মানহানী ঘটে,
> আল্লাহ ও মানুষের সুনজর থেকে বঞ্চিত হয়,
> ভাল উপাধির পরিবর্তে খারাপ উপাধিতে তাকে ডাকা হয়,
> তার অন্তর সংকীর্ণ ও কোনঠাসা হয়ে যায়, অনেকে সময় সে নিজ ইচ্ছার বিরুদ্ধে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দেয়।
> সে আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়ে জীবনের স্বাদ উপভোগ করতে চায়, অথচ আল্লাহর নিকট হতে শান্তি একমাত্র তার আনুগত্যের মাধ্যমেই পাওয়া সম্ভব, তার অবাধ্যতা কখনো কোনো কল্যান বয়ে আনতে পারে না।’
[রওজাতুল মুহিব্বিন : পৃ : ৩৬০]
তিনি আরো বলেন, ‘কর্ম অনুযায়ী ফলাফল দেয়া হয়। যে হারাম অশান্তির কারণ, সে হারামে লিপ্ত ব্যক্তি অশান্তি থেকে মুক্ত হতে চাইলেও মুক্ত হতে পারবে না, বরং তার আরো অশান্তি বৃদ্ধি পাবে। মৃত্যুর পরেও তার সঙ্গে অনুরূপ ব্যবহার করা হবে কবরে ও আখেরাতে।
সহিহ বোখারিতে সামুরা বিন জুনদুব রা. থেকে বর্ণিত হাদিসের কিছু অংশে বলা হয়েছে, রাসূল সা. বলেন, ‘… রাতে দেখলাম দু’জন ব্যক্তি আমার কাছে আসল এবং আমাকে ঘর থেকে বের করে তাদের সাথে নিয়ে চলল, হটাৎ চুলোর আকৃতির মত একটি ঘর দেখলাম, ওপরের অংশ সরু মাঝখানের অংশ খুব প্রসস্ত, তার নিচে আগুন জ্বলছে, ভেতরে উলঙ্গ নারী ও উলঙ্গ পুরুষ। যখন আগুন প্রজ্বলিত হয়, তারা আগুনের সঙ্গে ওপরে উঠে যায়। মনে হয়, এই যেন তারা বাইরে ছিটকে পড়ল। আগুন নিস্তেজ হলে আবার তারা নিচে চলে যায়। আমি জিজ্ঞেস করলাম : এরা কারা? উত্তর দিল, এরা ব্যভিচারী।’ একটু চিন্তা করে দেখুন, দুনিয়ার অবস্থা ও পরকালের শাস্তির সাথে কি মিল! দুনিয়াতে তারা তওবা সত্বেও ফিরে আসতে পারত না, গুনা ত্যাগ করার প্রতিজ্ঞা করেও তা রক্ষা করতে পারত না, প্রবৃত্তির লালসা মুক্ত হতে চেয়েও মুক্ত হতে পারত না, পুনরায় তাতে নিমজ্জিত হয়ে যেত, তাদের শাস্তিও সেরূপ হচ্ছে, দোজখ থেকে বের হওয়ার পথে এসেও বের হতে পারছে না। বরং পুনরায় তাতে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে।’ (রওজাতুল মুহিব্বিন : পৃ : ৪৪২)
আরেকটি জায়গায় তিনি বলেছেন, ‘জ্ঞানী ব্যক্তিদের জেনে নেয়া জরুরি, প্রবৃত্তপূজারীগণ এমন এক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে, যেখানে কোনো স্বাদ তারা পায় না, তা সত্বেও তারা তা ছাড়তে পারে না। কারণ, এটা তাদের জীবনের অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছে। এর প্রত্যক্ষ উদাহরণ, যারা মাদকাসক্ত ও যেনায় অভ্যস্ত তারা ঐ সব লোকদের ন্যায় সামান্য স্বাদও উপভোগ করতে পারে না, যারা বিরতি দিয়ে, পর পর এসব অপরাধে লিপ্ত হয়।’ (রওজাতুল মুহিব্বিন : পৃ : ৪৭০)
শায়খ মুহাম্মদ খিজির হুসাইন লিখেছেন, ‘ব্যভিচারের ক্ষতি অপরিসীম। এর অপকারিতা সুদূর প্রসারী : সম্মান নষ্ট হয়, মর্যাদা নষ্ট হয়, নিরাপত্তার পরিবেশ বিঘ্ন হয়, পরস্পর সুসম্পর্ক নষ্ট হয় এবং নানা মরণ ব্যাধির জন্ম হয়। ব্যভিচারী অর্থাৎ যারা চরিত্রহীন, সম্মানহীন, যাদের মধ্যে নিরাপত্তা বলতে কিছু নেই, যারা কাঁদা ছোড়াছুড়িতে লিপ্ত, যাদের শরীর রোগা শোকা, তাদের আবার কিসের জীবন?’ (রাসায়েলুল এসলাহ : পৃ : ২৩)
নারী প্রীতির প্রতিকার :
এ পর্যন্ত আমরা প্রবৃত্তি প্রসংগ নিয়ে আলোচনা করলাম, যা অনেকটাই বিস্তারিত। এখন আমরা এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার ও মুক্ত হওয়ার বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করব।
আবুলফারাজ ইবনে জাওজি রহ. ‘জাম্মুল হাওয়া’ এবং ইবনুল কাইয়ূম রহ. ‘রওজাতুল মুহিব্বীন’ নামক গ্রন্থে প্রবৃত্তির বিভিন্ন প্রকার ও প্রকৃতির ওপর বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ইবনে জাওজি রহ. প্রবৃত্তির প্রত্যেক প্রকার আলাদা আলাদা লিখে, আলাদা আলাদা চিকিৎসা পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন : হারাম দৃষ্টি প্রতিরোধের জন্য আলাদা চিকিৎসা, বেগানা নারীর সঙ্গ ত্যাগ করার আলাদা চিকিৎসা ইত্যাদি। এভাবে ইবনে জাওজি রহ. প্রবৃত্তির প্রায় পঞ্চাশটি চিকিৎসা পদ্ধতি সংক্ষেপে ও ধারাবাহিকভাবে উল্লেখ করেছেন।
এখানে আমরা আবুলফারাজ রহ. এর পদ্ধতি অনুসরণ করে উল্লেখ করছি, তিনি বলেন, ‘জেনে রেখ! প্রেম ও মহব্বতের রোগ ভিন্ন ভিন্ন। সে হিসেবে তার চিকিৎসাও ভিন্ন ভিন্ন হওয়া স্বাভাবিক। সবেমাত্র প্রেমে-পড়া ব্যক্তি আর দীর্ঘ দিন থেকে প্রেমে লিপ্ত ব্যক্তির চিকিৎসা এক নয়। তবে এটা ঠিক যে, প্রবৃত্তি ও প্রেম যতক্ষণ পর্যন্ত শেষ পর্যায়ে না পৌঁছুবে, ততক্ষণ তার চিকিৎসা সম্ভব। হ্যাঁ, চুরান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেলে, তখন আর চিকিৎসা সম্ভব নয়। সেটা হচ্ছে পাগল ও উন্মাদনার অবস্থা, যে অবস্থায় কোনো চিকিৎসা ফলপ্রসূ হয় না।’ (জাম্মুল হাওয়া : ৪৯৮)
তিনি আরো বলেন, ‘বার বার দৃষ্টির ফলে প্রেমিকার ছবি অন্তরে স্থীর হয়। যার নিদর্শন : অন্তরে শুধু সে-ই সে বিদ্যমান থাকে, অন্তরে অন্তরে তাকে অবলোকন করে, ঘুমে তাকে জড়িয়ে ধরে, একা একা তার সঙ্গে কথা বলে ইত্যাদি। জেনে রেখ! এর কারণ হচ্ছে প্রেমিকাকে পাওয়ার বাসনা। আর এ পাওয়ার বাসনাই অন্তরের একটি ব্যাধি হওয়ার জন্য যথেষ্ট। লম্পট ও বখাটেরা সম্ভাব্য চাওয়া পাওয়ার মধ্যেই লিপ্ত হয়, অসম্ভব নিয়ে তারা ব্যস্ত হয় না। কারণ, কেউ বাদশাহর স্ত্রীকে দেখে তার সঙ্গে অন্তরের যোগসূত্র কায়েম করে না। কারণ, সে জানে এ আশা কোনো দিন তার পুরণ হবে না, এখানে সে নিরাশ। সাধারণত যে যে জিনিসের ব্যাপারে আশাবাদী হয়, সে ঐ জিনিস অর্জন করার জন্যই চেষ্টা করে। কোনভাবে তা অর্জন করতে সক্ষম না হলে, আক্ষেপের আগুনে জ্বলে পুড়ে মরে।
এ থেকে পরিত্রাণের উপায় : প্রেমিকা থেকে দূরে থাকার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করা, তার প্রতি দৃষ্টি না দেয়া, তাকে পাওয়ার আশা ছেড়ে দেয়া, তার ব্যাপারে নিরাশ হয়ে যাওয়া।’ (জাম্মুল হাওয়া : ৫০১-৫০২)
আরেকটি স্থানে তিনি বলেন : ‘অন্তকরণ শুদ্ধ করার একটি পদ্ধতি হচ্ছে, তুমি মনে কর তোমার প্রেমিকা তোমার অন্তরের ধারণা অনুযায়ী বিদ্যমান নেই, তার ত্রুটিগুলো নিয়ে তুমি চিন্তা কর। কারণ, মানুষের ভেতরটা নাপাকি ও বর্জ্যে ভরা। এর মধ্যে প্রেমিক শুধু ভাল দিকটাই দেখে, তার প্রবৃত্ত তাকে প্রেমিকার খারাপ বস্তুগুলোর ব্যাপারে চিন্তা করতে দেয় না। দ্বিতীয়ত মানুষ স্বাভাবিক অবস্থায় না থাকলে, প্রকৃত বাস্তবতা বুঝতে সক্ষম হয় না। প্রবৃত্তি এমন জিনিস যে, শ্রীহীন ও অসুন্দর প্রেমিকাকেও প্রেমিকের নিকট সজ্জিত করে পেশ করে।
এ জন্যই ইবনে মাসউদ রা. বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যদি কোনো নারীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়, সে যেন সঙ্গে সঙ্গে সে নারীর বর্জ্য ও দুর্গন্ধ লাশের কথা চিন্তা করে।’ (জাম্মুল হাওয়া : ৫৪৬-৫৪৭ সংক্ষিপ্ত)
ইবনে কাইয়ূম রহ. এ ব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য যে পদ্ধতির কথা উল্লেখ করেছেন, তার কয়েকটি আমরা এখানে উল্লেখ করছি। তিনি বলেন, এ থেকে মুক্তি পাওয়ার একটি পদ্ধতি হচ্ছে, যেমন ‘এ কথা চিন্তা করা যে, আমাকে প্রবৃত্তির গোলাম হওয়ার জন্য সৃষ্টি করা হয়নি, আমাকে আরো বড় কাজ ও দায়িত্বের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে, যা প্রবৃত্তির বিরোধিতা ভিন্ন সম্পাদন করা সম্ভব নয়। যেমন কেউ বলেছে,
وقد هيؤوك لأمر لو فطنت له ু فاربأ بنفسك أن ترعى مع الهمل.
‘সে তোমাকে এমন এক মহৎ কাজের জন্য সৃষ্টি করেছে, যদি তুমি জানতে! তুমি নিজের ওপর রহম কর, অনর্থের পিছু নিয়ো না।’ (রওজাতুল মুহিব্বিন : ৪৭২)
‘প্রবৃত্তির অনুসরণ ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করা। কারণ, যে কেউ স্বীয় প্রবৃত্তির অনুসরণ করেছে, সে নিজের মধ্যে অপমান বোধ করেছে। অতএব, প্রবৃত্তপূজারীদের দাপট ও অহংকারের ধোঁকায় পতিত হওয়া সমীচিন নয়। তারা অন্তরের দিক হতে খুব নিচু, তারা অপমাণিত। তারা দু’টি ঘৃণীত স্বভাবে অভিযুক্ত : অহংকার ও অপমান।’ (রওজাতুল মুহিব্বিন : ৪৭৩)
‘ জেনে রাখা জরুরি যে, যে স্থানেই প্রবৃত্তির অনুপ্রবেশ ঘটেছে, সে স্থানেই বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে। ইলমের সঙ্গে প্রবৃত্তির সংমিশ্রন হওয়ার ফলে বেদআত ও গোমরাহীর জন্ম হয়েছে, এ প্রবৃত্তি দুনিয়ার মোহ ত্যাগকারীদের মধ্যে প্রবেশ করে, তাদেরকে সুন্নতপরিপন্থী করে দিয়েছে, বাদশাদের দরবারে প্রবেশ করে, তাদেরকে অত্যাচারী ও সত্য প্রত্যাখ্যানকারী বানিয়েছে, নিয়োগ কমিটিতে প্রবেশ করে, তাদেরকে আল্লাহ ও মুসলমানদের সঙ্গে খেয়ানতকারী বানিয়ে দিয়েছে, যার ফলে নিয়োগও প্রবৃত্তের জন্য বদলি-বাতিলও প্রবৃত্তের জন্য।’ (রওজাতুল মুহিব্বিন : ৪৭৪)
‘প্রবৃত্তির সঙ্গে যুদ্ধ করা যদিও কাফেরদের সঙ্গে যুদ্ধ করার সমান নয়, তবু ছোটও নয়। জনৈক ব্যক্তি হাসান বসরি রহ.-কে জিজ্ঞাসা করে ছিল, ‘হে আবু সাইদের বাপ! কোন্ জিহাদ সব চেয়ে উত্তম? তিনি বললেন, প্রবৃত্তের সঙ্গে যুদ্ধ করা। আমাদের উস্তাদ শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ.-কে বলতে শুনেছি, ‘কাফের, মুনাফেকদের সাথে জেহাদ করার মূলেও প্রবৃত্তের সঙ্গে জেহাদ করা। কারণ, তাদের সাথে জেহাদ করার আগে নিজের নফস ও প্রবৃত্তের সাথে জেহাদ না হলে, জেহাদের জন্য বের হওয়াও সম্ভব হতো না।’ (রওজাতুল মুহিব্বিন : ৪৭৮)
‘প্রবৃত্তের অনুসরণ আল্লাহ প্রদত্ত্ব সাহায্যের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়, লাঞ্ছনার দরজাসমূহ উন্মুক্ত করে দেয়। প্রবৃত্তির অনুসারীরা বলে, যদি আল্লাহ তওফিক দেয়, তবে এ করব, সে করব ইত্যাদি। অথচ সে প্রবৃত্তির অনুসরণ করে নিজের জন্য তওফিকের দরজাসমূহ বন্ধ করে দিয়েছে। ফুজায়েল ইবনে আয়াজ রহ. বলেন, যে ব্যক্তির ওপর নফস্ ও প্রবৃত্তির অনুসরণ প্রবল হয়, তার জন্য তওফিকের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়।’ (রওজাতুল মুহিব্বিন : ৪৭৯)
‘প্রবৃত্ত ও তওহিদ হচ্ছে দু’মেরুর দু’টি জিনিস। প্রবৃত্তি একটি মূর্তির ন্যায়, যার অন্তরে প্রবৃত্তির পরিমাণ বেশী, তার অন্তরে এ মূর্তির অস্তিত্বও শক্তিশালী। আল্লাহ তাআলা রাসূলদের মাটির তৈরি মূর্তি ভাঙ্গার জন্য ও এক আল্লাহর এবাদত প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রেরণ করেছেন। এর অর্থ এ নয় যে, মাটির তৈরী মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেলো আর অন্তরের মূর্তি গুলো রেখে দাও। বরং অন্তর থেকে মূর্তি দূর করার নির্দেশই প্রথম। লক্ষ্য করুন ইবারিহমের বাণীর প্রতি। আল্লাহ তাআলা বলেন,
“যখন সে তার পিতা ও কওমকে বলল, ‘এ মূর্তিগুলো কী, যেগুলোর পূজায় তোমরা রত রয়েছ’? (আম্বিয়া : ৫২) কি চমৎকার মিল! অন্তরে বিদ্যমান মূর্তি ও আল্লাহকে দিয়ে যেসব মূর্তির এবাদত করা হয় তার মাঝে।’ (রওজাতুল মুহিব্বিন : পৃ :৪৮১-৪৮২)
প্রত্যেক ব্যক্তির একটি শুরু আছে, আরেকটি আছে শেষ। যার শুরু প্রবৃত্তি দিয়ে তার শেষ হবে লাঞ্ছনা, অপমান, নৈরাশ্য ও মুসিবতের মাধ্যমে। প্রবৃত্তির অনুসরণ অনুপাতে এর আকারও বেশী হতে থাকবে, অবশেষে এটি শাস্তিতে পরিণত হবে এবং তাকে ভেতরে ভেতরে পুড়ে মারবে। যেমন কেউ বলেছেন,
‘যৌবনে অনেক স্বপ্ন ও অনেক আশা ছিলো, যা বার্ধক্যে হতাশা ও অশান্তিতে পরিণত হয়েছে।’
মুসিবত ও পতিত অবস্থার লোকদের পরখ করলে দেখা যাবে যে, তাদের শুরুটা হয়েছে প্রবৃত্তির অনুসরণ ও বিবেককে বর্জন করার মধ্য দিয়ে। পক্ষান্তরে যার শুরুটা হবে প্রবৃত্তির বিরোধিতা ও বিবেকচালিত, তার শেষটাও হবে সম্মান ও মর্যাদার। আল্লাহর নিকটে সে সম্মানিত, মানুষের নিকটও সে সম্মানিত। মাহলাব ইবনে আবু সাকরকে প্রশ্ন করা হয়ে ছিলো, তুমি এ মর্যাদায় কিভাবে উন্নীত হয়েছ? তিনি বলেন, বিবেকের অনুসরণ ও প্রবৃত্তের বিরুদ্ধাচারণ করে। এটা হচ্ছে দুনিয়ার শুরু শেষ। পরকালের প্রতিদান হলো, যে ব্যক্তি প্রবৃত্তির বিরুদ্ধাচারণ করবে, তার স্থান জান্নাত আর যে ব্যক্তি প্রবৃত্তির অনুকরণ করবে, তার স্থান জাহান্নাম।’ (জাম্মুল হওয়া : ৪৮৩,৪৮৪)
মুদ্দা কথা : প্রত্যেক রোগের ঔষধ রয়েছে, যে জানলো সে-তো জানলোই। আর যে জানলো না সে মুর্খই রয়ে গেল। তবে, শেষ কথা হচ্ছে, যে ব্যক্তি এ ধরনের প্রবৃত্তির জালে আবদ্ধ হয়ে যায়, তার উচিত দেরি না করে, দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে এর কিচিৎসায় লেগে যাওয়া। ধৈর্যধারণ করা, ধৈর্যের আসবাব গ্রহণ করা এবং সম্মানজনক কাজে ব্যাপৃত হওয়া, নোংরামি হতে দূরে থাকা, আল্লাহর সত্তাকে নিয়ে ধ্যানমগ্ন হওয়া, নফস্কে প্রবৃত্তি, কু-বাসনা ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত রাকা, নেককার লোকদের সঙ্গ গ্রহণ করা, আল্লাহর দরবারে সর্বদা অবনত মস্তক হয়ে থাকা এবং তার দরাবারে নিজেকে সর্বতোভাবে সোর্পদ করা।
চলবে……………ইনশাআল্লাহ্
ইবনে জাওজী রহ. এসব বিপর্যয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন,
‘নারী প্রেম ও নারী আসক্তির প্রায়শ্চিত্য বিভিন্ন প্রকার। কখনো ভোগ করতে হয় সঙ্গে সঙ্গে কখনো দেরিতে, কখনো প্রকাশ পায় কখনো তা পায় না। আবার এর কিছু শাস্তি রয়েছে যা আক্রান্ত ব্যক্তি নিজেও বুঝতে সক্ষম হয় না। তবে সব চেয়ে বড় শাস্তি হচ্ছে
> আল্লাহকে ভুলে যাওয়া ও ইমান বিলুপ্ত হওয়া।
> নারী আসক্তি ও গুনাহের কারণে অন্তর মরে যায়,
> যার ফলে সে আল্লাহর সঙ্গে মুনাজাতের স্বাদ আস্বাদন করতে সক্ষম হয় না,
> পবিত্র কুরআন তার অন্তরে অবস্থান করে না।
> এস্তেগফারসহ অন্যান্য এবাদত তার কাছে অর্থহীন মনে হয়।
> আরো অনেক ধর্মীয় অবক্ষয় রয়েছে, যা তাকে আস্তে আস্তে গ্রাস করে নেয়, যা সে অনুধাবনও করতে পারে না।
> তার অন্তরের দিগন্ত জুড়ে বিস্তৃত হয় গুনাহের অন্ধকার,
> নষ্ট হয়ে যায় তার অন্তর দৃষ্টি, যার প্রভাব পড়ে তার শরীরেও। যেমন, চোখের দৃষ্টি চলে যায়, স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে ইত্যাদি।
তাই অন্তরের মধ্যে গুনাহের আসক্তি উপলব্দি করার সাথে সাথে তওবা করা, হয়তো এর দ্বারা আসন্ন বিপদ দূরীভূত হয়ে যাবে।’ [জাম্মুল হাওয়া : ২১৭]
অবৈধ ভালবাসা সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়াহ রহ. বলেন,
‘নারী কিংবা ছোট বাচ্চাদের আসক্তি ব্যক্তিকে এমন বিপর্যয়ে নিপতিত করতে পারে, যার থেকে উদ্ধার করার ক্ষমতা কারো নেই। এর পরিণতি খুবই ভয়াবহ, তার পূন্যের ভাণ্ডার একেবারে শূন্য হয়ে যায়। প্রথম পর্যায়ে কারো অন্তরে কোন চেহারার আসক্তি সৃষ্টি হলে, দ্বিতীয় পর্যায়ে সে তার ভালবাসায় মগ্ন হয়ে যায়। যার ফলশ্রুতিতে সে আস্তে আস্তে নানা অপকর্ম ও অপরাধে জড়িত হয়ে পড়ে, যা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। তবে সব চেয়ে বড় মসিবত হচ্ছে আল্লাহর রহমত থেকে দূরে নিক্ষিপ্ত হওয়া। কারণ, বান্দা যখন আল্লাহর এবাদত ও তার প্রতি নিবিষ্ট চিত্ত থাকে, তখন তার কাছে আল্লাহর মহব্বতের চেয়ে মধুর ও সুখকর কোন জিনিস হতে পারে না।’ [মাজমুউল ফতওয়া : খ ১০, পৃ : ১৮৭]
তিনি আরো বলেছেন, গুনাহের প্রতি আসক্তি অন্তরের অন্যতম ব্যাধি, যা উন্মাদনার জন্ম দেয়। লুত আ.-এর জাতি সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন,
‘তোমার জীবনের কসম, নিশ্চয় তারা তাদের নেশায় ঘুরপাক খাচ্ছিল।’ [হিজর : ৭২]
বুখারি ও মুসলিমে বর্ণিত একটি হাদিসে এসেছে, আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘চোক্ষুদ্বয়ও যেনা করে, চক্ষুর যেনা হচ্ছে দৃষ্টি।’
অনেকেই প্রবৃত্তির তাড়নায় পরনারীর প্রতি দৃষ্টি দেয়, তাদের কথা শ্রবণ করে ও তাদের সঙ্গে বাক্যালাপ করতে চায়। আবার কেউ এর চেয়ে অগ্রগামী হয়ে র্স্পশ, চুম্বন ও সংগ লাভ করতে চায়। এসব কিছুই নিষিদ্ধ ও হারাম। এসব লোকদের ওপর শাস্তি নিশ্চিত করার ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা আমাদের নমনীয় হতে ও দয়া দেখাতে নিষেধ করেছেন। (মুসলমানদের সরকার না থাকলে বা তাদের শাস্তির কোন ব্যবস্থা না থাকলে) সামাজিকভাবে তাদের বয়কট করা, তাদেরকে এ থেকে নিষেধ করা ও তাদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করা। অতএব যেনার এসব প্রাথমিক কার্যাদি ও যেনার অন্যান্য সকল উপায়-উপকরণ ত্যাগ করা, তার থেকে দূরে থাকা সবার জন্য একান্ত জরুরি।’
[মাজমুউল ফতওয়া : খ : ১৫ পৃ : ২৮৮, ২৮৯]
ইবনুল কাইয়ূম রহ. যেনা-ব্যভিচারের ক্ষতি, বিপর্যয় ও সর্বনাশ সম্পর্কে তার লেখার অনেক জায়গায় আলোকপাত করেছেন। তিনি একজায়গায় বলেন,
‘যেনা-ব্যভিচার সকল অপকর্ম ও অনিষ্টের মূল। ব্যক্তির দীনদারী, কৌলিণ্য, সুস্থ রুচিবোধ ও আত্মমর্যাদা সব নিঃশেষ করে দেয় এ অপকর্মটি। ব্যভিচারীর মধ্যে দীনদারী, ওয়াদা রক্ষা ও সততা থাকে-না বললেই চলে।
আরো কিছু ক্ষতিকর দিক হচ্ছে :
> আল্লাহর নিদের্শ অমান্য করা ও তার সৃষ্ট প্রকৃতির মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা।
> নিজ চেহারা কলুষিত করা এবং নিজকে চিন্তা ও পেরেশানীর ঘাটে উপস্থিত করা।
> এর ফলে ব্যক্তির অন্তর কালো হয়,
> অন্তরদৃষ্টি লোপ পায়,
> সম্মানহানী ঘটে,
> আল্লাহ ও মানুষের সুনজর থেকে বঞ্চিত হয়,
> ভাল উপাধির পরিবর্তে খারাপ উপাধিতে তাকে ডাকা হয়,
> তার অন্তর সংকীর্ণ ও কোনঠাসা হয়ে যায়, অনেকে সময় সে নিজ ইচ্ছার বিরুদ্ধে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দেয়।
> সে আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়ে জীবনের স্বাদ উপভোগ করতে চায়, অথচ আল্লাহর নিকট হতে শান্তি একমাত্র তার আনুগত্যের মাধ্যমেই পাওয়া সম্ভব, তার অবাধ্যতা কখনো কোনো কল্যান বয়ে আনতে পারে না।’
[রওজাতুল মুহিব্বিন : পৃ : ৩৬০]
তিনি আরো বলেন, ‘কর্ম অনুযায়ী ফলাফল দেয়া হয়। যে হারাম অশান্তির কারণ, সে হারামে লিপ্ত ব্যক্তি অশান্তি থেকে মুক্ত হতে চাইলেও মুক্ত হতে পারবে না, বরং তার আরো অশান্তি বৃদ্ধি পাবে। মৃত্যুর পরেও তার সঙ্গে অনুরূপ ব্যবহার করা হবে কবরে ও আখেরাতে।
সহিহ বোখারিতে সামুরা বিন জুনদুব রা. থেকে বর্ণিত হাদিসের কিছু অংশে বলা হয়েছে, রাসূল সা. বলেন, ‘… রাতে দেখলাম দু’জন ব্যক্তি আমার কাছে আসল এবং আমাকে ঘর থেকে বের করে তাদের সাথে নিয়ে চলল, হটাৎ চুলোর আকৃতির মত একটি ঘর দেখলাম, ওপরের অংশ সরু মাঝখানের অংশ খুব প্রসস্ত, তার নিচে আগুন জ্বলছে, ভেতরে উলঙ্গ নারী ও উলঙ্গ পুরুষ। যখন আগুন প্রজ্বলিত হয়, তারা আগুনের সঙ্গে ওপরে উঠে যায়। মনে হয়, এই যেন তারা বাইরে ছিটকে পড়ল। আগুন নিস্তেজ হলে আবার তারা নিচে চলে যায়। আমি জিজ্ঞেস করলাম : এরা কারা? উত্তর দিল, এরা ব্যভিচারী।’ একটু চিন্তা করে দেখুন, দুনিয়ার অবস্থা ও পরকালের শাস্তির সাথে কি মিল! দুনিয়াতে তারা তওবা সত্বেও ফিরে আসতে পারত না, গুনা ত্যাগ করার প্রতিজ্ঞা করেও তা রক্ষা করতে পারত না, প্রবৃত্তির লালসা মুক্ত হতে চেয়েও মুক্ত হতে পারত না, পুনরায় তাতে নিমজ্জিত হয়ে যেত, তাদের শাস্তিও সেরূপ হচ্ছে, দোজখ থেকে বের হওয়ার পথে এসেও বের হতে পারছে না। বরং পুনরায় তাতে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে।’ (রওজাতুল মুহিব্বিন : পৃ : ৪৪২)
আরেকটি জায়গায় তিনি বলেছেন, ‘জ্ঞানী ব্যক্তিদের জেনে নেয়া জরুরি, প্রবৃত্তপূজারীগণ এমন এক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে, যেখানে কোনো স্বাদ তারা পায় না, তা সত্বেও তারা তা ছাড়তে পারে না। কারণ, এটা তাদের জীবনের অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছে। এর প্রত্যক্ষ উদাহরণ, যারা মাদকাসক্ত ও যেনায় অভ্যস্ত তারা ঐ সব লোকদের ন্যায় সামান্য স্বাদও উপভোগ করতে পারে না, যারা বিরতি দিয়ে, পর পর এসব অপরাধে লিপ্ত হয়।’ (রওজাতুল মুহিব্বিন : পৃ : ৪৭০)
শায়খ মুহাম্মদ খিজির হুসাইন লিখেছেন, ‘ব্যভিচারের ক্ষতি অপরিসীম। এর অপকারিতা সুদূর প্রসারী : সম্মান নষ্ট হয়, মর্যাদা নষ্ট হয়, নিরাপত্তার পরিবেশ বিঘ্ন হয়, পরস্পর সুসম্পর্ক নষ্ট হয় এবং নানা মরণ ব্যাধির জন্ম হয়। ব্যভিচারী অর্থাৎ যারা চরিত্রহীন, সম্মানহীন, যাদের মধ্যে নিরাপত্তা বলতে কিছু নেই, যারা কাঁদা ছোড়াছুড়িতে লিপ্ত, যাদের শরীর রোগা শোকা, তাদের আবার কিসের জীবন?’ (রাসায়েলুল এসলাহ : পৃ : ২৩)
নারী প্রীতির প্রতিকার :
এ পর্যন্ত আমরা প্রবৃত্তি প্রসংগ নিয়ে আলোচনা করলাম, যা অনেকটাই বিস্তারিত। এখন আমরা এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার ও মুক্ত হওয়ার বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করব।
আবুলফারাজ ইবনে জাওজি রহ. ‘জাম্মুল হাওয়া’ এবং ইবনুল কাইয়ূম রহ. ‘রওজাতুল মুহিব্বীন’ নামক গ্রন্থে প্রবৃত্তির বিভিন্ন প্রকার ও প্রকৃতির ওপর বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ইবনে জাওজি রহ. প্রবৃত্তির প্রত্যেক প্রকার আলাদা আলাদা লিখে, আলাদা আলাদা চিকিৎসা পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন : হারাম দৃষ্টি প্রতিরোধের জন্য আলাদা চিকিৎসা, বেগানা নারীর সঙ্গ ত্যাগ করার আলাদা চিকিৎসা ইত্যাদি। এভাবে ইবনে জাওজি রহ. প্রবৃত্তির প্রায় পঞ্চাশটি চিকিৎসা পদ্ধতি সংক্ষেপে ও ধারাবাহিকভাবে উল্লেখ করেছেন।
এখানে আমরা আবুলফারাজ রহ. এর পদ্ধতি অনুসরণ করে উল্লেখ করছি, তিনি বলেন, ‘জেনে রেখ! প্রেম ও মহব্বতের রোগ ভিন্ন ভিন্ন। সে হিসেবে তার চিকিৎসাও ভিন্ন ভিন্ন হওয়া স্বাভাবিক। সবেমাত্র প্রেমে-পড়া ব্যক্তি আর দীর্ঘ দিন থেকে প্রেমে লিপ্ত ব্যক্তির চিকিৎসা এক নয়। তবে এটা ঠিক যে, প্রবৃত্তি ও প্রেম যতক্ষণ পর্যন্ত শেষ পর্যায়ে না পৌঁছুবে, ততক্ষণ তার চিকিৎসা সম্ভব। হ্যাঁ, চুরান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেলে, তখন আর চিকিৎসা সম্ভব নয়। সেটা হচ্ছে পাগল ও উন্মাদনার অবস্থা, যে অবস্থায় কোনো চিকিৎসা ফলপ্রসূ হয় না।’ (জাম্মুল হাওয়া : ৪৯৮)
তিনি আরো বলেন, ‘বার বার দৃষ্টির ফলে প্রেমিকার ছবি অন্তরে স্থীর হয়। যার নিদর্শন : অন্তরে শুধু সে-ই সে বিদ্যমান থাকে, অন্তরে অন্তরে তাকে অবলোকন করে, ঘুমে তাকে জড়িয়ে ধরে, একা একা তার সঙ্গে কথা বলে ইত্যাদি। জেনে রেখ! এর কারণ হচ্ছে প্রেমিকাকে পাওয়ার বাসনা। আর এ পাওয়ার বাসনাই অন্তরের একটি ব্যাধি হওয়ার জন্য যথেষ্ট। লম্পট ও বখাটেরা সম্ভাব্য চাওয়া পাওয়ার মধ্যেই লিপ্ত হয়, অসম্ভব নিয়ে তারা ব্যস্ত হয় না। কারণ, কেউ বাদশাহর স্ত্রীকে দেখে তার সঙ্গে অন্তরের যোগসূত্র কায়েম করে না। কারণ, সে জানে এ আশা কোনো দিন তার পুরণ হবে না, এখানে সে নিরাশ। সাধারণত যে যে জিনিসের ব্যাপারে আশাবাদী হয়, সে ঐ জিনিস অর্জন করার জন্যই চেষ্টা করে। কোনভাবে তা অর্জন করতে সক্ষম না হলে, আক্ষেপের আগুনে জ্বলে পুড়ে মরে।
এ থেকে পরিত্রাণের উপায় : প্রেমিকা থেকে দূরে থাকার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করা, তার প্রতি দৃষ্টি না দেয়া, তাকে পাওয়ার আশা ছেড়ে দেয়া, তার ব্যাপারে নিরাশ হয়ে যাওয়া।’ (জাম্মুল হাওয়া : ৫০১-৫০২)
আরেকটি স্থানে তিনি বলেন : ‘অন্তকরণ শুদ্ধ করার একটি পদ্ধতি হচ্ছে, তুমি মনে কর তোমার প্রেমিকা তোমার অন্তরের ধারণা অনুযায়ী বিদ্যমান নেই, তার ত্রুটিগুলো নিয়ে তুমি চিন্তা কর। কারণ, মানুষের ভেতরটা নাপাকি ও বর্জ্যে ভরা। এর মধ্যে প্রেমিক শুধু ভাল দিকটাই দেখে, তার প্রবৃত্ত তাকে প্রেমিকার খারাপ বস্তুগুলোর ব্যাপারে চিন্তা করতে দেয় না। দ্বিতীয়ত মানুষ স্বাভাবিক অবস্থায় না থাকলে, প্রকৃত বাস্তবতা বুঝতে সক্ষম হয় না। প্রবৃত্তি এমন জিনিস যে, শ্রীহীন ও অসুন্দর প্রেমিকাকেও প্রেমিকের নিকট সজ্জিত করে পেশ করে।
এ জন্যই ইবনে মাসউদ রা. বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যদি কোনো নারীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়, সে যেন সঙ্গে সঙ্গে সে নারীর বর্জ্য ও দুর্গন্ধ লাশের কথা চিন্তা করে।’ (জাম্মুল হাওয়া : ৫৪৬-৫৪৭ সংক্ষিপ্ত)
ইবনে কাইয়ূম রহ. এ ব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য যে পদ্ধতির কথা উল্লেখ করেছেন, তার কয়েকটি আমরা এখানে উল্লেখ করছি। তিনি বলেন, এ থেকে মুক্তি পাওয়ার একটি পদ্ধতি হচ্ছে, যেমন ‘এ কথা চিন্তা করা যে, আমাকে প্রবৃত্তির গোলাম হওয়ার জন্য সৃষ্টি করা হয়নি, আমাকে আরো বড় কাজ ও দায়িত্বের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে, যা প্রবৃত্তির বিরোধিতা ভিন্ন সম্পাদন করা সম্ভব নয়। যেমন কেউ বলেছে,
وقد هيؤوك لأمر لو فطنت له ু فاربأ بنفسك أن ترعى مع الهمل.
‘সে তোমাকে এমন এক মহৎ কাজের জন্য সৃষ্টি করেছে, যদি তুমি জানতে! তুমি নিজের ওপর রহম কর, অনর্থের পিছু নিয়ো না।’ (রওজাতুল মুহিব্বিন : ৪৭২)
‘প্রবৃত্তির অনুসরণ ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করা। কারণ, যে কেউ স্বীয় প্রবৃত্তির অনুসরণ করেছে, সে নিজের মধ্যে অপমান বোধ করেছে। অতএব, প্রবৃত্তপূজারীদের দাপট ও অহংকারের ধোঁকায় পতিত হওয়া সমীচিন নয়। তারা অন্তরের দিক হতে খুব নিচু, তারা অপমাণিত। তারা দু’টি ঘৃণীত স্বভাবে অভিযুক্ত : অহংকার ও অপমান।’ (রওজাতুল মুহিব্বিন : ৪৭৩)
‘ জেনে রাখা জরুরি যে, যে স্থানেই প্রবৃত্তির অনুপ্রবেশ ঘটেছে, সে স্থানেই বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে। ইলমের সঙ্গে প্রবৃত্তির সংমিশ্রন হওয়ার ফলে বেদআত ও গোমরাহীর জন্ম হয়েছে, এ প্রবৃত্তি দুনিয়ার মোহ ত্যাগকারীদের মধ্যে প্রবেশ করে, তাদেরকে সুন্নতপরিপন্থী করে দিয়েছে, বাদশাদের দরবারে প্রবেশ করে, তাদেরকে অত্যাচারী ও সত্য প্রত্যাখ্যানকারী বানিয়েছে, নিয়োগ কমিটিতে প্রবেশ করে, তাদেরকে আল্লাহ ও মুসলমানদের সঙ্গে খেয়ানতকারী বানিয়ে দিয়েছে, যার ফলে নিয়োগও প্রবৃত্তের জন্য বদলি-বাতিলও প্রবৃত্তের জন্য।’ (রওজাতুল মুহিব্বিন : ৪৭৪)
‘প্রবৃত্তির সঙ্গে যুদ্ধ করা যদিও কাফেরদের সঙ্গে যুদ্ধ করার সমান নয়, তবু ছোটও নয়। জনৈক ব্যক্তি হাসান বসরি রহ.-কে জিজ্ঞাসা করে ছিল, ‘হে আবু সাইদের বাপ! কোন্ জিহাদ সব চেয়ে উত্তম? তিনি বললেন, প্রবৃত্তের সঙ্গে যুদ্ধ করা। আমাদের উস্তাদ শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ.-কে বলতে শুনেছি, ‘কাফের, মুনাফেকদের সাথে জেহাদ করার মূলেও প্রবৃত্তের সঙ্গে জেহাদ করা। কারণ, তাদের সাথে জেহাদ করার আগে নিজের নফস ও প্রবৃত্তের সাথে জেহাদ না হলে, জেহাদের জন্য বের হওয়াও সম্ভব হতো না।’ (রওজাতুল মুহিব্বিন : ৪৭৮)
‘প্রবৃত্তের অনুসরণ আল্লাহ প্রদত্ত্ব সাহায্যের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়, লাঞ্ছনার দরজাসমূহ উন্মুক্ত করে দেয়। প্রবৃত্তির অনুসারীরা বলে, যদি আল্লাহ তওফিক দেয়, তবে এ করব, সে করব ইত্যাদি। অথচ সে প্রবৃত্তির অনুসরণ করে নিজের জন্য তওফিকের দরজাসমূহ বন্ধ করে দিয়েছে। ফুজায়েল ইবনে আয়াজ রহ. বলেন, যে ব্যক্তির ওপর নফস্ ও প্রবৃত্তির অনুসরণ প্রবল হয়, তার জন্য তওফিকের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়।’ (রওজাতুল মুহিব্বিন : ৪৭৯)
‘প্রবৃত্ত ও তওহিদ হচ্ছে দু’মেরুর দু’টি জিনিস। প্রবৃত্তি একটি মূর্তির ন্যায়, যার অন্তরে প্রবৃত্তির পরিমাণ বেশী, তার অন্তরে এ মূর্তির অস্তিত্বও শক্তিশালী। আল্লাহ তাআলা রাসূলদের মাটির তৈরি মূর্তি ভাঙ্গার জন্য ও এক আল্লাহর এবাদত প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রেরণ করেছেন। এর অর্থ এ নয় যে, মাটির তৈরী মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেলো আর অন্তরের মূর্তি গুলো রেখে দাও। বরং অন্তর থেকে মূর্তি দূর করার নির্দেশই প্রথম। লক্ষ্য করুন ইবারিহমের বাণীর প্রতি। আল্লাহ তাআলা বলেন,
“যখন সে তার পিতা ও কওমকে বলল, ‘এ মূর্তিগুলো কী, যেগুলোর পূজায় তোমরা রত রয়েছ’? (আম্বিয়া : ৫২) কি চমৎকার মিল! অন্তরে বিদ্যমান মূর্তি ও আল্লাহকে দিয়ে যেসব মূর্তির এবাদত করা হয় তার মাঝে।’ (রওজাতুল মুহিব্বিন : পৃ :৪৮১-৪৮২)
প্রত্যেক ব্যক্তির একটি শুরু আছে, আরেকটি আছে শেষ। যার শুরু প্রবৃত্তি দিয়ে তার শেষ হবে লাঞ্ছনা, অপমান, নৈরাশ্য ও মুসিবতের মাধ্যমে। প্রবৃত্তির অনুসরণ অনুপাতে এর আকারও বেশী হতে থাকবে, অবশেষে এটি শাস্তিতে পরিণত হবে এবং তাকে ভেতরে ভেতরে পুড়ে মারবে। যেমন কেউ বলেছেন,
‘যৌবনে অনেক স্বপ্ন ও অনেক আশা ছিলো, যা বার্ধক্যে হতাশা ও অশান্তিতে পরিণত হয়েছে।’
মুসিবত ও পতিত অবস্থার লোকদের পরখ করলে দেখা যাবে যে, তাদের শুরুটা হয়েছে প্রবৃত্তির অনুসরণ ও বিবেককে বর্জন করার মধ্য দিয়ে। পক্ষান্তরে যার শুরুটা হবে প্রবৃত্তির বিরোধিতা ও বিবেকচালিত, তার শেষটাও হবে সম্মান ও মর্যাদার। আল্লাহর নিকটে সে সম্মানিত, মানুষের নিকটও সে সম্মানিত। মাহলাব ইবনে আবু সাকরকে প্রশ্ন করা হয়ে ছিলো, তুমি এ মর্যাদায় কিভাবে উন্নীত হয়েছ? তিনি বলেন, বিবেকের অনুসরণ ও প্রবৃত্তের বিরুদ্ধাচারণ করে। এটা হচ্ছে দুনিয়ার শুরু শেষ। পরকালের প্রতিদান হলো, যে ব্যক্তি প্রবৃত্তির বিরুদ্ধাচারণ করবে, তার স্থান জান্নাত আর যে ব্যক্তি প্রবৃত্তির অনুকরণ করবে, তার স্থান জাহান্নাম।’ (জাম্মুল হওয়া : ৪৮৩,৪৮৪)
মুদ্দা কথা : প্রত্যেক রোগের ঔষধ রয়েছে, যে জানলো সে-তো জানলোই। আর যে জানলো না সে মুর্খই রয়ে গেল। তবে, শেষ কথা হচ্ছে, যে ব্যক্তি এ ধরনের প্রবৃত্তির জালে আবদ্ধ হয়ে যায়, তার উচিত দেরি না করে, দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে এর কিচিৎসায় লেগে যাওয়া। ধৈর্যধারণ করা, ধৈর্যের আসবাব গ্রহণ করা এবং সম্মানজনক কাজে ব্যাপৃত হওয়া, নোংরামি হতে দূরে থাকা, আল্লাহর সত্তাকে নিয়ে ধ্যানমগ্ন হওয়া, নফস্কে প্রবৃত্তি, কু-বাসনা ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত রাকা, নেককার লোকদের সঙ্গ গ্রহণ করা, আল্লাহর দরবারে সর্বদা অবনত মস্তক হয়ে থাকা এবং তার দরাবারে নিজেকে সর্বতোভাবে সোর্পদ করা।
চলবে……………ইনশাআল্লাহ্