জিহাদ নাম দিয়ে
নিরপরাধ নারী ও শিশুদেরকে হত্যা করা যাবে?
১৬ই ডিসেম্বর, ২০১৪ পাকিস্তানের পেশোয়ারে
আর্মিদের দ্বারা পরিচালিত একটি স্কুলের ক্লাসরুমে ঢুকে কয়েকজন রক্তপিপাসু ভয়ংকর
খুনি “ইয়াহুদী” স্টাইলে অত্যন্ত ঠান্ডা
মাথায়, পরিকল্পিতভাবে গুলি করে একে একে ১৩০ জনের বেশি
ছাত্রকে হত্যা করে। “তেহেরিকে তালেবান” নামে চরমপন্থী, জংগী
একটি সংগঠন, যারা এই সন্ত্রাসীদেরকে ব্রেইন ওয়াশ করে
মানবতাবিরোধী এই কাজ করতে পাঠিয়েছে, তারা দাবী করছে, “এইভাবে স্কুলের
নিরস্ত্র,
নিরীহ ছাত্রদেরকে নির্দয়ভাবে হত্যা করে তারা ইসলামের পবিত্র কাজ,
জিহাদ(!) করছে!”
শুধু তাই নয়, নিজেদের এই বর্বর কাজকে “জায়েজ” প্রমান করার জন্য চরমপন্থী,
জংগীরা কুরআন-হাদীসের মনগড়া অপব্যখ্যা করে সাধারণ মানুষকে ধোঁকা
দেওয়ার অপচেষ্টা করে। হক্ক কথা হচ্ছে, এরা আসলে
ইয়াহুদী-খ্রীস্টানদের দ্বারা মগজ ধোলাই খাওয়া মুসলমান ছদ্মবেশী গোপন এজেন্ট,
যাদের মিশন হচ্ছে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিধান “জিহাদ” কে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড
হিসেবে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা, যাতে করে মুসলমানদেরকে “জংগী” লেবেল দিয়ে যখন ইচ্ছা তখন
আক্রমন করে মুসলমান দেশগুলো দখল করা যায়।
.
আল-কায়েদাহ, আইসিস, জেএমবির মতো কথিত মুজাহিদদের দাবী হচ্ছেঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম মুশরিকদের নিরস্ত্র পুরুষ, নিরীহ নারী ও শিশু,
যারা মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ বা বিশ্বাসঘাতকতার মতো অপরাধের সাথে
জড়িত নয়, তাদেরকেও যখন ইচ্ছা টার্গেট করে নির্বিচারে
পাইকারীভাবে হত্যা করার অনুমতি দিয়েছেন (নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক)! মানবতাবিরোধী
তাদের এই সন্ত্রাসী নীতির পক্ষে নিচের এই হাদীসের অপব্যাখ্যা পেশ করেঃ
সা’ব ইবনু জাসসামা রাদিয়াল্লাহু আ’নহু হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, মুসলমানদের রাত্রিকালের
অভিযানের ফলে শত্রুপক্ষের মুশরিকদের কিছু মহিলা ও শিশুরা নিহত হয়, তাহলে কি হবে? আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম
জবাবে বলেছিলেন, “তারা
মুশরিকদের সাথে বলেই গণ্য হবে।”
সহীহ বুখারীঃ ৩০১২, সহীহ মুসলিমঃ ৭৫৪৫,
আবু দাউদঃ ২৬৭২, তিরমিযীঃ ১৫১৭, ইবনু মাজাহঃ ২৮৩৯, আহমাদঃ ২৭৯০২, মালেকঃ ৯৮১, দারেমীঃ ২৬৪২।
.
হাদীসের ব্যখ্যাঃ
সহীহ বুখারীর ব্যখ্যাগ্রন্থ ‘ফাতহুল বারী’ তে ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী
রাহিমাহুল্লাহ এই হাদীস সম্পর্কে বলেছেন, “এই হাদীসের অর্থ এই না যে, নারী
ও শিশুদেরকে টার্গেট করে হত্যা করা যাবে। বরং, এই হাদীসের
অর্থ হচ্ছে এই যে, মুশরেকদের সাথে যুদ্ধের সময় যদি নারী ও
শিশুরা অস্ত্রবহনকারী শত্রুদের মাঝে অবস্থান করে এবং একারণে তারা নিহত হয়, তাহলে মুসলমানদের কোন দোষ হবেনা।” ফাতহুল বারীঃ সহীহ বুখারীর ৩০১২, ২৩৭০ নং হাদীসের ব্যখ্যা।
সুবহা’নাল্লাহ!!
চিন্তা করে দেখুন, হাদীসের কি পরিমান
অপব্যখ্যা তারা করেছে?
হাদীসের অর্থ হচ্ছেঃ যুদ্ধের সময় অস্ত্রবহনকারী
মুশরেকদের মাঝে যদি নারী ও শিশুরা অবস্থান করে, আর সেই অবস্থায় তাদের কেউ
নিহত হয়, তাহলে কোন দোষ নেই। আর এই হাদীসকে তারা ব্যবহার
করছে যুদ্ধের সাথে যাদের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই এমন নিরস্ত্র, নিরীহ ছাত্রদেরকে আক্রমন করে তাদেরকে গণহত্যা করার জন্য!?
সবচাইতে আশ্চর্যজনক ব্যপার হচ্ছে,
জিহাদ সম্পর্কে চরম অজ্ঞ, মনগড়া ফতুয়াবাজ এই
লোকগুলো এটাও জানেনা যে, উপরের এই হাদীসটি আসলে পরবর্তীতে ‘মানসুখ’ বা রহিত করে দেওয়া হয়েছে!
নীচের হাদীস দ্বারা উপরের হাদীসকে রহিত করে দেওয়া হয়েছেঃ
উমার রাদিয়াল্লাহু আ’নহু থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন এক গাযওয়ায় (যুদ্ধের অভিযানে) এক মহিলাকে নিহত অবস্থায়
দেখতে পেলেন। তখন রাসুলুল্লাহ অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন এবং নারী ও শিশুদেরকে হত্যা
করা নিষিদ্ধ করে দেন।” সুনানে
তিরমিযী। হাদীসটিকে ইমাম তিরমিযী রহঃ ‘হাসান সহীহ’ এবং শায়খ আলবানী রহঃ ‘সহীহ’ সাব্যস্ত করেছেন।
বুখারী ও মুসলিমের অপর বর্ণনায় রয়েছে, “তিনি (রাসুলুল্লাহ)
সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া
সাল্লাম মহিলা ও শিশুদেরকে হত্যা করতে নিষেধ করেছেন।” সহীহ বুখারীঃ ৩০১৪, সহীহ মুসলিমঃ ১৭৪৪, আবু দাউদঃ ২৬৬৮, তিরমিযীঃ ১৫৬৯, ইবনু মাজাহঃ ২৮৪১, আহমাদঃ ৪৭২৫, মালেকঃ ৯৮১, দারেমী;
২৬৪২।
একারণে উপরে প্রথমে বর্ণিত বুখারীর হাদীস, যেখানে
দেখা যাচ্ছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম “যুদ্ধের
ময়দানে অস্ত্রধারী মুশরেকদের মাঝে অবস্থানকারী নারী ও শিশুরা নিহত হলে সেটাকে
খারাপ বলেন নি”, সেই
হাদীসের একজন গুরুত্বপূর্ণ রাবী, যিনি সাহাবীর কাছ থেকে
হাদীসটি বর্ণনা করেছেন, তাবেয়ী ইমাম ইবনে শিহাব আয-যুহরী
রাহিমাহুল্লাহ, সহীহ বুখারীর প্রথম হাদীসটি যতবারই বর্ণনা
করতেন, ততবারই সাথে সাথে এই কথা উল্লেখ করে দিতেন যে,
“পরবর্তীতে এই
হাদীসটিকে রহিত করে দেওয়া হয়েছে”!
ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী রাহিমাহুল্লাহ ফাতহুল বারীতে
উল্লেখ করেছেন, “ইমাম
আয-যুহরী কখনোই সহীহ বুখারীর এই হাদীসটি বর্ণনা করতেন না, যার
সাথে সাথে এই হাদীসটিও উল্লেখ করে দিতেন যে,
(১) “আমাকে কাব ইবনু
মালিক বলেছেন, যিনি তার চাচার কাছ থেকে শুনেছেন, রাসুল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন তাঁর সৈন্যদেরকে পাঠালেন ইবনে আবিল হাকিক্বের
সাথে যুদ্ধ করার জন্য, “রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেকোন অবস্থাতেই
নারী ও শিশুদেরকে হত্যা করা নিষিদ্ধ করেছেন, এমনকি যদিওবা শত্রুরা নারী
ও শিশুদেরকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে।”
(২) সুফিয়ান বর্ণনা করেছেন, ইমাম যুহরী আরো বর্ণনা করেছেন, “রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম হুনাইনের যুদ্ধে সর্ব অবস্থাতেই নারী ও শিশুদেরকে হত্যা করা সম্পূর্ণরুপে
নিষিদ্ধ করেছেন। আর এটাই ছিলো রাসুলুল্লাহ এর জীবনে মুশরিকদের বিরুদ্ধে সর্বশেষ
যুদ্ধ।”
(৩) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) এর কাছে একজন দূতকে পাঠান এবং বলেন, “শিশু ও আসিফদেরকে
হত্যা করোনা।” (আসিফ
হচ্ছে কৃষক, সাধারণ কর্মী, দাস বৃদ্ধ,
অর্থাৎ শত্রুপক্ষের এমন লোক যারা যুদ্ধ করছেনা)
উৎসঃ ফাতহুল বারীঃ সহীহ বুখারীর ৩০১২, ২৩৭০
নং হাদীসের ব্যখ্যা।
আমাদের দেশের কিছু অল্প বয়ষ্ক, জাহেল
আল-মুরাক্কাব, ফেইসবুক (ফেইক) মুজাহিদরা এধরনের মারাত্বক
অপব্যখ্যা করে “তেহেরিকে
তালেবানের” এবং
অন্যান্যদের সন্ত্রাসী ও বর্বর কর্মকান্ডকে “জায়েজ” এবং এটাকে পবিত্র জিহাদ(!) সাব্যস্ত সরলমনা
মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করে। উল্লেখ করা যেতে পারে, কথিত এই
অনলাইন মুজাহিদরা আসলে আনোয়ার আওলাকি নামে একজন এমেরিকান ইংলিশ স্পিকিং বক্তার
২০১০ সালে আরবীতে দেওয়া একটা ইন্টারভিউয়ের উপর ভিত্তি করে এই ধরণের অপব্যখ্যামূলক
ফতোয়ার কপি-পেস্ট করে যাচ্ছে।
আনোয়ার আল-আওলাকি, যাকে তারা বড় আলেম বলে মনে
করে (আসলে একজন বক্তা, যে অনেক ভালো এবং মন্দ কথাও প্রচার
করেছে) সেই ভিডিওতে বলেছিলো, “যুদ্ধের মাঠের বাইরে (৯/১১ এর মতো মুসলিম বা কাফের
যেকোনো দেশে) আত্মঘাতী বোমা হামলা করে নিরস্ত্র কাফেরদেরকে হত্যা করা ইসলামে জায়েজ, এমনকি
যদিও তাতে অনেক নিরীহ নারী ও শিশু নিহত হয়।”
এর পক্ষে সে বুখারী থেকে উক্ত হাদীসের অপব্যখ্যাটাকে
রেফারেন্স হিসেবে উল্লেখ করেছিলো। আর সেই থেকে আজ পর্যন্ত, যত
ধরণের সন্ত্রাসী আক্রমন করছে নামধারী এই মুসলমানেরা (আসলে কাফেরদের সাজানো নাটকের
অভিনেতা), আওলাকি ভক্তরা বিভিন্ন যুক্তি ও হাদীসের অপব্যখ্যা
দেখিয়ে তাদের ইমামের মতোই সেইগুলোকে অন্ধভাবে সমর্থন করে যাচ্ছে। আল্লাহু
মুস্তায়ান!
.
সর্বশেষ, যারা কষ্ট করে আমার এই
দীর্ঘ এই পোস্টটি পড়েছেন, তাদেরকে অনুরোধ করবো, বিগত শতাব্দীর একজন প্রকৃত ফকীহ ও আলেমে দ্বীন, আল্লামাহ
মুহাম্মদ বিন সালেহ আল-উসায়মিন রাহিমাহুল্লাহর একটি কথা গভীর ভাবে চিন্তা করার
জন্য,
“অনেক মানুষকে জ্ঞান দেয়া হয়েছে, কিন্তু
অর্জিত সেই জ্ঞান অনুধাবন করার মতো ক্ষমতা তাদেরকে দেওয়া হয়নি। না বুঝে শুধু
কুরআন মাজীদ ও হাদীস মুখস্থ করাই যথেষ্ট নয়। বরং অবশ্য-ই আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীসের মর্মার্থ আপনাকে বুঝতে হবে। ঐ লোকদের
দ্বারা কতইনা ত্রুটি-বিচ্যুতি সংঘটিত হয়েছে, যারা আল্লাহ্ ও
তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীসের বাণীর মর্ম না বুঝেই দলীল
পেশ করছে, যার ফলে তাদের অনুসারীদের মাঝে অনেকেই পথভ্রষ্ট
হয়েছে।”
আল্লাহ আমাদের সকলকে হক্ক জানার, বুঝার
এবং মানার তোওফিক দান করুন, আমিন। বারাকাল্লাহ ফীকুম।