বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৪

"ফাসি হওয়া আব্দুল কুদ্দুস এখনো আমার সামনে এসে দাড়ায় !"

গল্পটা একজন ভারতীয় অমুসলিম লেখকের বই থেকে সংগৃহীত যদিও তিনি দাবী করেছিলেন সত্যি ঘটনাকে পূজি করে লিখা সত্যি ঘটনা নাকি মিথ্যা, আল্লাহু ভালো জানেন, তবে আমাদের মতো দেশে আদালতে যেইভাবে সত্যকে মিথ্যা ও মিথ্যাকে সত্য বানানো হয় সে হিসেবে এই গল্পটা বাস্তবতার সাথে সম্পূর্ণ সামাজস্যপূর্ণ আপনারা নাহ গল্প মনে করেই পড়ুন আর সেই সমস্ত মানুষদের কথা চিন্তা করুন, যারা নিরপরাধ হইয়েও দুনিয়ার আদালাতে জুলুমে শিকার হচ্ছেন।  
________________________
ফাঁসি হওয়া আব্দুল কুদ্দুস এখনো আমার সামনে এসে দাড়ায়
- ডেপুটি জেলার (চারুচন্দ্র চক্রবর্তী)।
ডেপুটি জেলার হিসেবে যোগদানের এগার মাস পরই ১৯৬৪ সালে একটি ফাঁসি কার্যকরের দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর এর আগে ফাঁসি দেওয়ার অভিজ্ঞতা আমার ছিল না
আমি তখন বরিশাল জেলা কারাগারে চাকরি করি ফাঁসি কার্যকরের মতো একটি দায়িত্ব পাওয়ার পর আমার খারাপ লাগছিল এরপরও চাকরি করি, তাই এই দায়িত্ব আমাকে পালন করতেই হবে জেনেশুনেই এই চাকরিতে যোগ দিয়েছি। এরপরও তো আমি একজন মানুষ আমার সামনে ফাঁসির রশিতে ঝুলে একজন তরতাজা মানুষ জীবন হারাবে, ভাবতেই কেমন জানি লাগছিল
স্মৃতিতে যত দূর মনে পড়ে, যার ফাঁসি কার্যকর করেছিলাম তার নাম আব্দুল কুদ্দুস বাড়ি বরিশালের উজিরপুর এলাকায় পেশায় কৃষিজীবী হলেও সে ছিল সুদর্শন যুবক বাবাকে জবাই করার দায়ে তার ফাঁসির রায় হয়েছিল
তারিখ মনে নেই, তবে ঘটনাটা মনে আছে
সিনিয়র অফিসারের নির্দেশে আমি ফাঁসি কার্যকরের দিন বিকেলে আব্দুল কুদ্দুসের সেলে যাই গিয়ে দেখি আব্দুল কুদ্দুস মনমরা হয়ে বসে আছে তখনো সে জানে না আজ রাতেই তার ফাঁসি হবে। আমি গিয়ে জানালাম ভেবেছিলাম শুনেই সে আঁতকে উঠবে কিন্তু দেখলাম তার মাঝে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না মনে হলো সে প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছে শুধু বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, স্যার, ফাঁসি-টাসি কেয়ার করি না তবে কি, পিতাকে হত্যা না করেও হত্যার অভিযোগ নিয়ে দুনিয়া ছেড়ে যেতে হচ্ছে, এটাই দুঃখ
তার কথা শুনে চমকে উঠলাম এই কারণে যে, তার কথা অনুযায়ী অপরাধ না করেও তাকে ফাঁসিতে ঝুলতে হচ্ছে!
আগ্রহ জন্মাল ঘটনাটি জানার
আব্দুল কুদ্দুস আমাকে জানাল, তার বাবা দুই বিয়ে করেছে প্রথম স্ত্রীর ছেলে সে। মা মারা যাওয়ার পর তার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে সেই ঘরে দুই মেয়ের জন্ম হয় প্রত্যেকেই বড় হয়, বিয়েশাদি করে আব্দুল কুদ্দুসেরও এক ছেলে হয় তার বাবার বিষয়-সম্পত্তি দখলের জন্য সৎ বোনের জামাই হন্যে হয়ে ওঠে তার বোন, বোনজামাই ও সৎ মা মিলে পরিকল্পনা করে তার বাবাকে হত্যার সেই হত্যার দায় চাপানোর জন্য তাকে আসামি করার পরিকল্পনাও করে
এক রাতে স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করে আব্দুল কুদ্দুস তার বাবার বিছানায় শুয়ে থাকে। বাবা চলে গিয়েছিল অন্য ঘরে ওই রাতে তার বোনজামাই বাবাকে হত্যার জন্য যায় গিয়ে কাঁথা সরিয়ে দেখতে পায় আব্দুল কুদ্দুসকে তাকে দেখে দ্রুত চলে যায়। সেদিন আব্দুল কুদ্দুস বুঝতে পেরেছিল তার বাবাকে হত্যার জন্যই চেষ্টা করছে তারা এর ক-দিন পর এক রাতে তার বোন ও বোনজামাই তার বাবাকে জবাই করে
বিষয়টি আব্দুল কুদ্দুস আঁচ করতে পেরেও কিছুই করতে পারেনি বরং তার মা বাদী হয়ে আব্দুল কুদ্দুসকেই প্রধান আসামি করে মামলা দায়ের করে
মা, বোন ও বোনজামাই প্রত্যেকেই আব্দুল কুদ্দুস হত্যা করেছে বলে আদালতে সাক্ষ্য দেয় মায়ের সাক্ষ্যকে আদালত গ্রহণ করে সেই সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আব্দুল কুদ্দুসের ফাঁসির রায় হয় বলে সে আমাকে জানায়
এসব কথা বলার সময় আব্দুল কুদ্দুস অঝোর ধারায় কাদতে থাকে সেই কান্না দেখাও ছিল বেশ কষ্টকর আব্দুল কুদ্দুসের ইচ্ছা কি জানতে চাওয়া হলে সে একটি চিঠি লেখার আগ্রহ প্রকাশ করে
তাকে চিঠি লেখার জন্য কাগজ-কলম দিয়ে সেল থেকে বিদায় হই
কুদ্দুসকে ফাঁসি দেওয়ার সব আয়োজন সম্পন্ন করা হলো রাত দশটার দিকে কুদ্দুসের সেলে যাই আমি আব্দুল কুদ্দুস তার লেখা চিঠিটি দেয় আমার হাতে
অনুরোধ করে বলল, স্যার আমি আপনার পায়ে ধরি চিঠিটি আমার মায়ের কাছে পৌঁছে দেবেন
আমি তাকে কথা দিলাম তার চিঠি অবশ্যই আমি পৌছে দেওয়ার ব্যবস্থা করব
চিঠিটি নিয়ে পড়ার আগ্রহ বোধ করলাম। দেখলাম সে লিখেছে,
মা, তুমি তোমার জামাই মিলে বাবারে হত্যা করলা আর আমারে দিলা ফাঁসি কোর্টে সাক্ষী দিলা যে আমিই মারছি ঠিক আছে আমি তো চলে যাচ্ছি, তোমার সঙ্গে দেখা হবে ওপারে রোজ হাশরের মাঠে তোমার সঙ্গে ওইখানে মোকাবেলা হবে আর একটা কথা, আমার বউ যদি অন্য কোথাও বিয়ে করতে চায় তুমি বাঁধা দিও না তুমি যত দিন বাইচা থাকবা তত দিন আমার ছেলেকে দেখবা তুমি আমার ছেলেকে পড়াবা
আমি যখন একা কবরে যাচ্ছি, তোমাকেও একা কবরে যেতে হবে সে সময় তোমার মেয়ের জামাই ও মেয়ে কিন্তু সঙ্গে যাবে না দুনিয়ায় তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে এত বড় অপরাধ করলা কিন্তু তাদের কাউকে তুমি পাবা না তোমার সঙ্গে চূড়ান্ত হিসাব-নিকাশ হবে হাশরের ময়দানে
এই কথাগুলো আব্দুল কুদ্দুস কয়েকবার লিখেছিল চিঠির কাগজটি ভেজা ছিল বোঝাই যাচ্ছিল লেখার সময় তার চোখ বেয়ে পানি ঝরছিল খুব যে কারণে চোখের পানিতে কালি লেপটে যায়
চিঠিটি নিয়ে সিনিয়র অফিসারকে দিলাম তার কাছে জানতে চাইলাম চিঠিটি কিভাবে পাঠাব তিনি পরামর্শ দিলেন রেজিস্ট্রি ডাকে পাঠানোর জন্য নিজের টাকা খরচ করে সেই চিঠিটি আমি পাঠিয়েছিলাম
রাত আড়াইটার দিকে ফাঁসি দেওয়ার সময় নির্ধারণ করা হলো নিয়ম অনুযায়ী এক ঘণ্টা আগে গিয়ে আব্দুল কুদ্দুসকে গোসল করানো হলো এরপর সে নামাজ আদায় করল মসজিদের ইমাম গিয়ে তাকে তওবা পড়ান ফাঁসির কিছুক্ষণ আগে আব্দুল কুদ্দুসের কাছে জানতে চাইলাম, সে শেষবারের মতো কিছু খেতে চায় কি না
সে বলল, একটু দুধ খাবেআমরা দ্রুত দুধের ব্যবস্থা করলামদুধটুকু খাওয়ার পর আব্দুল কুদ্দুসই বলল, স্যার চলেন।
নিয়ম অনুযায়ী তার দুই হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দিলাম সেল থেকে পঞ্চাশ গজের মতো দূরে ফাঁসির মঞ্চে আমরা তাকে নিয়ে গেলাম কারণ ফাঁসির আসামি যদি মঞ্চে না গিয়ে দৌড় দেয় বা অন্য কিছু করে বসে সে কারণে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে নিতে হয়সেখানে গিয়ে আব্দুল কুদ্দুস কোনো ঝামেলা না করেই ফাঁসির রশি গলায় ঝোলাল
এ সময় ম্যাজিস্ট্রেট ডি জি সেনগুপ্ত, সিভিল সার্জন আবদুল লতিফ, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও কারাগারের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন
সকালে লাশ নেওয়ার জন্য পরিবারের সদস্যদের ডাকা হয় লাশ গ্রহণ করতে তার মা আসেনি এসেছিল তার বড় বোন ও তার স্বামী কয়েক ঘণ্টা আগেই আমি আব্দুল কুদ্দুসের মুখ থেকে শুনেছিলাম তার সৎ বোন ও স্বামী তার বাবাকে জবাই করেছে এ কারণে নিজের আগ্রহ থেকে তাদের দুজনকে জানালাম যে, আব্দুল কুদ্দুস মৃত্যুর আগে বলে গেছে আপনারা হত্যা করে সেই দায় আব্দুল কুদ্দুসের ওপর চাপিয়েছেন
এ সময় তারা দুজনই থতমত খেয়ে গেলেও পুরো ঘটনাটি অস্বীকার করে
দীর্ঘ দিন কারাগারে চাকরি করেছি অনেক মানুষের ফাঁসি কার্যকরের সময় উপস্থিত ছিলাম
কিন্তু আব্দুল কুদ্দুসের ফাঁসিটি এখনো আমার মনে পড়ে
আব্দুল কুদ্দুস স্বপ্নে এখনো আমার সামনে এসে দাড়ায়
নতুন করে বলে, তার মৃত্যুর কাহিনী

(সমাপ্ত)